করোনায় গৃহবন্দী থাকা মানে নাবিক জীবনের চর্চা করা!

প্রকাশিত: ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৭, ২০২০

মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ছুটে চলা কোন জাহাজের নাবিক নই আমারা, কিন্তু কোভিড-১৯ এর মহামারীতে গৃহবন্দী জীবন আমাদের সবাইকে ক্ষনিকের জন্য হলেও সেই জীবনের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে। গৃহবন্দী জীবনে নিজের অজান্তেই আমারা চর্চা করে চলেছি অনেক সামুদ্রিক জীবনের অভ্যাস।
নাবিক জীবনের একটা বড় দিক হচ্ছে কোলাহল পূর্ন সমাজ থেকে দূরে থাকা কিন্তু প্রকৃতির একান্ত কাছে থাকা। যা বর্তমানের সামাজিক দূরত্ব রেখে গৃহবন্দী জীবনের সাথে অনেক মিলে যায়। নাবিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তাই এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কিছু ইতিবাচক দিক খোঁজার চেষ্টা করেছি এখানে।

●আত্মসমর্পণ এবং অভিযোজন
করোনা ভাইরাস যতটাই প্রানঘাতী হোকনা কেন এটা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত আপাতত সমাধান লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। এটা ছাড়া অন্যকোন পন্থাও খোলা নেই, সুতরাং এটার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারি আমারা। আমাদের উদ্ভাবক, সৃজনশীল, অভিযোজ্য এবং নমনীয় হওয়া দরকার। গন্ডিবদ্ধ জীবনাচরণ, অভ্যাস এবং আচরণগুলি বিরক্তিতে পরিণত হতে পারে। তবে মানিয়ে নেয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় কি, বেঁচে থাকার জন্য!
“We can’t direct the wind, but we can adjust the sail”
একজন নাবিককের কাছে যেমন নতুন একটা দিন মানে নতুন একটা চ্যালেঞ্জ।

●সীমিত পরিসরে আটকে থাকা
লকডাউন মেনে চলা মানে গন্ডীবদ্ধ জায়গায় বাধ্যবাধকতার সাথে আপোষ করে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে চলা। যেমনি চলমান জাহাজে কয়েক মিটার মাত্র জায়গায় আপনি হাঁটতে পারবেন। লকডাউনে অপরিহার্য না হলে কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই। এমন অবস্থায় একা থাকাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, এমনকি পরিবারের সাথে থাকলেও পারিবারিক শান্তি এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখাটাও খুব চ্যালেঞ্জ হতে পারে। নাবিক জীবনে এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়মিত এবং এগুলো মোকাবেলার জন্য রয়েছে টেবিল টেনিস থেকে শুরু করে বাস্কেটবল এর মতো অনেক ধরনের ইনডোর খেলাধুলার ব্যাবস্থা, বিনোদন এর জন্য মুঠোফোন থেকে শুরু করে বড় পর্দার টিভি, শরীর চর্চার জন্য জিমনেশিয়াম অথবা ছোটখাটো সুইমিংপুল। গৃহবন্দী হলেও এটা মাথায় রাখবেন আপনার কাছে অন্তত আপনার ঘরের মেঝের বিলাসিতা রয়েছে যা জাহাজের মত চলন্ত না। আপনার চারপাশে কি আছে দেখুন, সুস্থ থাকার জন্য কাজে লাগান।

●আমাকে কেমন দেখতে লাগছে কে জানে!
সাধারণত মাঝ সাগরে আমি ঢিলেঢালা আরামদায়ক সাদা পরিস্কার পোশাক পরতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ভালো পোশাক পরে দেখানোর কেউ নেই। আর মাঝ সাগরেতো নরসুন্দর নেই, তাই চুলকাটা থেকে দাড়ি কামানো নিজের কাজ নিজেকে সারতে হয়। যেমনটা না লকডাউনে সেলুন, পার্লার/ রুপচর্চার প্রয়োজনীয়তা বা সুযোগ দুটোই খুব কম।

●বিবেচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় সরবরাহ ঘরে রাখা
একজন সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন কে পরবর্তী সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার, জল, জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে অন্যান্য সামগ্রী এমনকি অতি দরকারী ঔষধ পর্যাপ্ত আছে কিনা নিশ্চিত করে তারপর পরবর্তী গন্তব্যে যাত্রা শুরু করতে হয়। লকডাইনে নিত্য কেনাকাটা পরিহার করে বিবেচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় সরবরাহ ঘরে রাখা আক্ষরিক অর্থে নাবিক জীবনের এইদিকটা চর্চা করার মতো।

●স্বাধীন দার্শনিক
আপনি কি জানেন যে একজন লোক গড়ে একদিনে ২,৮০০ টি পছন্দ করে?সংখ্যাটা সকলের জন্য সঠিক কিনা আমি জানি না, তবে আমি বিশ্বাস করি আমরা এর কাছাকাছি রয়েছি।কেবলমাত্র একটা সুপারমার্কেট এর ভিতরে ১ ঘন্টা ঘুরলেই ১০০ টা নতুন সিদ্ধান্ত আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাবে। লকডাউনে আমাদের চিন্তাভাবনা গুলো এখন সীমিত, ঘোরাঘুরি কম।এজন্য নিজের, নিজের জীবনের, নিজের পরিবারের দেয়ার জন্য অতিরিক্ত সময় রয়েছে আমাদের হাতে। নিজেকে আবিষ্কার করার সময়।
“The real voyage of discovery consists not in seeking new landscapes, but in having new eyes.” – MARCEL PROUST (French Novelist).

●স্বনির্ভরতা
মাঝ সাগরে আমরা কিছু ঠিক করার জন্য কাউকে ভাড়া নিতে পারি না। পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সাথে সাথে আমাদের উদ্ভাবক হতে হয়, বড় কোন ব্রেকডাউন ছাড়া বাকিটা আমাদের নিজেদের ঠিক করতে হয়। মাথায় রাখতে হয় আটলান্টিকের মাঝখানে কোনও দোকান বা গুগল নেই। এভাবেই কাজের মাঝে শেখা, নতুন দিন মানে নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন অভিজ্ঞতা একজন নাবিককে অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন এ পরিনত করে। কঠোর লকডাউনে যেমন দোকানপাটে তালা তেমনি এখন অনেক বাড়িতে কাজেরলোক নাই, সামান্য সমস্যায় নেই সমাধানের পথ। অগত্যা নিজেই চেষ্টা করা, ঘরের কাজ নিজেরাই করা। অনেকে হয়তো অভ্যস্ত নই, অনেকে হয়তোবা জানিনা, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!

●বই পড়া মানে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির সাথে জানার পরিধি বৃদ্ধি
অফিসে শিডিউল নাই, বন্ধুদের আড্ডা নাই, মাঠের খেলা নাই, রাজনীতি/অর্থনীতি নিয়ে চায়ের কাপে তর্ক-বিতর্ক নাই, একান্ত নিজের কিছু সময়।নতুন একটা বই পড়ার মোক্ষম সময়। বই পড়তে হয় একাকী এবং তাতে অবসর ভরে ওঠে নির্মল আনন্দে, বুদ্ধি আসে বইয়ের কথামালা থেকে, আর সক্ষমতা আসে গ্রন্থগত বিদ্যার সঙ্গে বিষয়বুদ্ধির সংশ্লেষে। আপনার জ্ঞান, দক্ষতা এবং শখগুলি প্রসারিত করার এটাই সময়।
●পরিকল্পনা
করোনা মহামারী আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, মৌলিক চাহিদা চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমরা কতটা নাজুক। করোনা পরবর্তী পরিকল্পনা হোক মৌলিক চাহিদার যথাযথ প্রাপ্তি নিয়ে।
যেমনকরে নীল জলরাশি তে দুর্বার ছুটে চললেও একজন নাবিকের নীল স্বপ্ন গুলো ঘিরে থাকে তার আপনজন, পরিবার, বন্ধু, সমাজ….. পরিকল্পনা থাকে তাদের ঘিরে।

পরিশেষে,
টাইটানিক থেকে শুরু করে, বৈরী আবহাওয়া অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পড়ে সমুদ্রগামী জাহাজডুবির ইতিহাস অনেক আছে। ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিকও শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত প্রানপনে চেষ্টা করে যায়, নিজের ক্রু-মেম্বারদের জন্য, নিজের জন্য। একটা লাইফজ্যাকেট অথবা একটা ভাসমান কাঠের টুকরো ধরে, মনে এই আশা নিয়ে যে, “জরুরি বার্তা পেয়ে কোন উদ্ধারকারী দল আসবে তার জন্য।”
COVID-19 ভাইরাস, সমস্ত বিশ্বকে নাড়িয়ে সবাইকে গৃহবন্দী হতে বাধ্য করেছে।ফাঁকা করেছে পথঘাট, বন্ধ করেছে যানবাহন, ব্যস্ত অফিসপাড়া করেছে শূন্য, পানশালা থেকে ধর্মশালায় দিয়েছে তালা! অজানা ভীতি, অনিশ্চিত পরিনতির দিকে এগিয়ে চলেছে সারা বিশ্ববাসী!
বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে আমিও আশাবাদী,
কোন একদিন সকালে ঘুমথেকে উঠে খবর আসবে–
করোনা মহামারী থেকে মুক্ত মানবজাতি। উদ্ধারকারী দলের মতো কেউ ভ্যাকসিন নিয়ে আসবে। আবার হাসবে পৃথিবী।


Tanmay Roy
From a Merchant Vessel.
Time : 1200 UT, 12-June-2020
Place : Arabian Sea West Coast , Indian Ocean.