নদী দূষণ রোধ এবং পানি সম্পদ রক্ষায় আমাদের করণীয়

প্রকাশিত: ১২:৫০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২০

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ছিল ‘আমার তোমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা যমুনা।’ নদী শুধু আমাদের ঠিকানাই নয়, নদী আমদের ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, কৃষি, মৎস্য পালন, পণ্য পরিবহন, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকার অনুষঙ্গ। সেই নদী নিয়েই অনুষ্ঠিত হলো গত ২৫ নভেম্বর, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘দূষণ, ভাঙন, নাব্য সংকট, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভা। সভায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে, তার ৯৩ ভাগ আসে অন্য দেশগুলো থেকে। প্রবাহিত পানি নিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণে পলি, যা আমাদের নদী ভরাটের অন্যতম কারণ। নদীগুলো মানুষের মতো জন্মের ২০ বয়সে থাকে তরুণ, ৪০ বছর পর্যন্ত থাকে মধ্যবয়সি এবং ৪০ বছরের পর হয়ে যায় বৃদ্ধ। বৃদ্ধ নদীগুলো হয় আঁকা-বাঁকা। এই আঁকা-বাঁকা নদীগুলোর তীব্র ভাঙনে প্রতি বছর দেশের শত শত গ্রাম, নগর, শহর ও কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। নদীভাঙন ঠেকাতে হলে আমাদের বৃদ্ধ নদীগুলোকে যুবক নদীতে রূপান্তর করতে হবে। নদীর পলিমাটির পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। শুধু নদীভাঙন রোধ করলেই চলবে না, যে গ্রামগুলো নদীভাঙনে হারিয়ে গেছে, সেগুলোকেও উদ্ধার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান, বাংলাদেশের নদীগুলো বেঁচে থাকুক। দখল ও দূষণমুক্ত হোক। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের বেশির ভাগ নেতাই নদী দখল ও দূষণের সঙ্গে জড়িত। কেউ কেউ বলেন, নদী রক্ষার জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র নদী আইন ও স্বতন্ত্র নদী ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হালদার বলেন, নদী সুরক্ষার জন্য জেলা কালেক্টরদের প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব এবং ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ইউনিয়নের তহশিলদারদের। তার মতে, বিদ্যমান আইন অনুসারে নদীর জমি জনগণের। এ জমি রাষ্ট্রপতিও কাউকে দিতে পারেন না। নদীর পর্চা থাকে জেলা প্রশাসকদেরর কাছে, তিনিই জেলার সব নদীর জমির মালিক ও পাহারাদার। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় এমনকি নিজের খনন করা পুকুর পর্যন্ত সরকারের অনুমোদন ছাড়া ভরাট করা যায় নাÑ এমনই আইন আছে বাংলাদেশে। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ আইনে জেলা প্রশাসকদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার সঠিক প্রয়োগ থাকলে বাংলাদেশে নদী দখলের মতো কোনো ঘটনাই ঘটত না। জাতীয় নদী কমিশন গঠনের পর গত ১০ মাসে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) জেলা নদী রক্ষা কমিটি, উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সঙ্গে অনেকবার আলোচনা করেছে কমিশন। তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতার কথাও বলা হয়েছে বিস্তারিত। নদী উদ্ধারের ব্যাপারে হাইকোর্টে যে ঐতিহাসিক রায় আছে, সেটিও আমাদের বিজ্ঞ বিচারকদের বিবেচনা করতে হবে। নদীর জমি যাতে ভুয়া মালিক সাজিয়ে কেউ রেজিস্ট্রি করতে না পারে সে বিষয়েও উপজেলা রেজিস্ট্রারদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নদীভাঙন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী সুরক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য, রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ১০০ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পান গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশে এখনো থ্রি আর কর্মসূচি চালু হয়নি। উন্নত দেশেগুলোয় এ কর্মসূচি চালু আছে। থ্রি আর হলো রিডিউস, রিলিজ ও রিসাইক্লিন। এ কর্মসূচি না থাকার কারণেই নদীতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে গৃহস্থালি আবর্জনা এবং দূষিত হচ্ছে নদীর পরিবেশ। আমাদের দেশের শিল্পপতিরা তাদের মিল-কারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি নদী-নালা, খাল-বিলে নিক্ষেপ করে দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি করছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নির্বাচনী ইশতেহারে নদী রক্ষায় ১৭ নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অধিক দূষিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু, বংশী, কর্ণফুলীসহ অন্যান্য নদীর দূষণ বন্ধের লক্ষ্যে শিল্প-কারখানায় ২৪ ঘণ্টা ইটিপি চালু রাখা এবং মানবসৃষ্ট ও হাসপাতাল বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা করা। নদীর সীমানা রক্ষায় স্থায়ী সার্ভে কমিটি গঠন করে তিন মাস অন্তর নদীর পাড় সরেজমিন পরিদর্শন-পূর্বক নৌ-মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর ও পরিবেশবাদী সংগঠনের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে এবং অবৈধ দখল থেকে নদী রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নদী, পানি ও পরিবেশ রক্ষায় বিদ্যমান সংস্থাগুলোকে এক করে একটি সমন্বিত নদী ও পরিবেশ আইন তৈরির মাধ্যমে নদী-জলাশয়গুলোকে রক্ষায় এককভাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে ‘নদী ও পানিসম্পদ’ মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনর্গঠন করে দায়িত্ব প্রদানসহ আইনি সুরক্ষার জন্য ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’র মতো জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। পরিকল্পিতভাবে নদী খনন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু ও পলি উত্তোলনের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং খননকৃত মাটি বা পলি এমনভাবে পাড়ে ফেলতে হবে, যাতে বর্ষায় তা আবার নদীতে এসে না পড়ে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে শুধু খাবার পানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য গভীর নলকূপ রেখে বাকিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন হাওর-বাঁওড়-বিলে পতিত নদী-নালাগুলোরে উৎসমুখের বাঁধসমূহ ও অপরিকল্পিত স্লুইসগেটের অপসারণ করতে হবে।

পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা, নদীবান্ধব অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুকল্পে নদীবন্দরগুলো পুনর্গঠন ও সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। উজানের অভিন্ন নদীর পানিপ্রাপ্তিতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন, বাঁধ নির্মাণ রোধকল্পে যৌথ নদী কমিশনের কূটনৈতিক তৎপরতা ও কর্মকা-ের পরিধি বৃদ্ধি এবং ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ পানি প্রবাহ কনভেনশন, যা ইতোমধ্যে আইনে পরিণত হয়েছে, সেখানে অনুস্বাক্ষর করে প্রয়োজনে জাতিসংঘে বিষয়গুলো তুলে ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীভাঙন রোধে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ টিম তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নদী-নালা ও খালের অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট ও বাঁধ অপসারণ করে যথাযথ সমীক্ষাপূর্বক সেগুলো পরিকল্পিতভাবে তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষায় মানুষের মনে দায়িত্ববোধ সৃষ্টিতে প্রতিটি ব্রিজ, কালভার্টে সংশ্লিষ্ট নদী-নালা বা খালের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিমূলক নামফলক লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হাওর রক্ষায় হাওরের জলাশয়গুলোকে খননের আওতায় এনে জলমহালের ইজারা বাতিল করে হাওরের কৃষকদের অবাধে মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নদী-নালা, খাল-বিল ও সমুদ্র উপকূলে ইঞ্জিনচালিত নৌকার পোড়া তেল-মবিল, গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্প বর্জ্য, হাট-বাজার ও রাস্তা-ঘাটের ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন ইত্যাদি ফেলা বন্ধে আইনগত পদক্ষেপের পাশাপাশি গণসচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাঝারি ও ছোট নদী-নালা, খাল-বিলগুলোয় জলজ প্রাণী ও মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে এবং নদী রক্ষায় ও নদীর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিতে গণসচেতনতার জন্য নদী রক্ষাভিত্তিক গল্প, কবিতা, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং তা পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থাসহ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু নির্বাচনী ইশতেহারেই নয়, নদী রক্ষার জন্য দেশের প্রতিটি অঞ্চলে, বিশেষ করে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে তরুণ প্রজন্ম ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিসহ সব পেশার লোকদের। নদী রক্ষায় জাগ্রত করতে হবে মানুষের বিবেক, নদীর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মমত্ববোধ।

লেখক- মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ভূঁইয়া শাহাদাত পরিচালক- রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড

রেডিয়েন্ট ওশান রিসার্চ এন্ড এডুকেশন সেন্টার

দ্য লাইট হাউজ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ