বঙ্গোপসাগরে সন্ধান মিলল১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের

বঙ্গোপসাগরে সন্ধান মিলল১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের

প্রকাশিত: ৮:১০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২২

বঙ্গোপসাগরে গ্যাস হাইড্রেট ও কয়েকশো প্রজাতির সি-উইড আবিষ্কারের ফলে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে বাংলাদেশের সামনে। বুধবার বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ গ্যাস হাইড্রেটে রয়েছে বিপুল পরিমাণ মিথেন।

কপ-২৬-এ ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সবুজ জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। সেই রূপান্তরকে মসৃণ করার জন্য আরও দুই দশক প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজন দেশের।

এই পরিস্থিতিতে গ্যাস হাইড্রেট আবিষ্কার বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সহায়তায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সমুদ্রের মহীসোপানে ৬ হাজার ৫০০ লাইন কিলোমিটার পর্যন্ত দুটি জরিপ বিশ্লেষণ করে এবং একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় (ইইজেড) বিপুল সামুদ্রিক সম্পদ চিহ্নিত করে।

গ্যাস হাইড্রেট তথা মিথেন গ্যাস মূলত উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গঠিত জমাট বরফ আকৃতির এক ধরনের কঠিন পদার্থ। এটি স্তূপীকৃত বালির ছিদ্রের ভেতরে ছড়ানো স্ফটিক আকারে অথবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পিণ্ড, শিট বা রেখা আকারে বিদ্যমান থাকে।

সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানোর সময় মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার এডমিরাল খুরশেদ আলম (অব.) গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইইজেড ও মহীসোপানের সকল এলাকার পূর্নাঙ্গ সিসমিক জরিপ সম্পন্ন করা হলে [গ্যাস হাইড্রেটের] প্রকৃত মজুদ নিরূপণ করা সম্ভব হবে।’

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, জরিপের ফলাফল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে আগামী শতকে জ্বালানি সংকট নিরসনে এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎস হিসেবে গ্যাস হাইড্রেটের এই বিশাল মজুদ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎস হিসেবে এরকম বিশাল গ্যাস হাইড্রেট ভবিষ্যতের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি অতি দ্রুত এই গ্যাস হাইড্রেট উত্তোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জ্বালানি ক্ষেত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করবে।’

বাংলাদেশের কাছে কি হাইড্রেট থেকে গ্যাস উত্তোলনের প্রযুক্তি আছে? 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতাত্ত্বিক ড. বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাস হাইড্রেট থেকে গ্যাস উত্তোলনের প্রযুক্তি বিশ্বে এখনও সহজলভ্য হয়নি। এ কারণে এই বিশাল আবিষ্কার থেকে বাংলাদেশ তেমন লাভবান হতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘জাপান ও কানাডার মতো কিছু দেশ দরকারি প্রযুক্তির তৈরির চেষ্টা করছে। তবে তারা সফল হলেও বাংলাদেশের এটি পেতে আরও ১০-১৫ বছর সময় লেগে যাবে।’

এছাড়াও এ ধরনের মজুদ থেকে কত শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা যাবে, তা এখনও অজানা বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, যেকোনো সামুদ্রিক এলাকায় এ ধরনের গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক।

উদাহরণস্বরূপ, বঙ্গোপসাগরে, বিশেষ করে ভারতের কৃষ্ণ-গোদাভারী অববাহিকায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেটের মজুদের সম্ভাবনা বিষয়ে ভারত ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ভারত বঙ্গোপসাগরে বিশেষ করে কৃষ্ণা-গোদাবরী অববাহিকায় বিশাল গ্যাস হাইড্রেট রিজার্ভের সম্ভাবনার কথাও নিশ্চিত করেছে, ভারতের অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশনের তথ্য বলছে।

বাংলাদেশের মোট ২৭টি গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট মজুদ আছে। এর মধ্যে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮ দশমিক ২৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র চালু রয়েছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন ৩৫০ কোটি ঘনফুট জাতীয় চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ মাত্র ২৩০ কোটি ঘনফুট।

গত দুই দশকে দেশে কোনো উল্লেখযোগ্য গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। অথচ গ্যাসের চাহিদা আকাশচুম্বী। এ কারণে দেশের নিজস্ব গ্যাসের উৎস দ্রুত কমে আসছে।

গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি পূরণে শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন চলমান রাখতে বাংলাদেশ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে।

২০১৮ সাল থেকে সরকার দুটি ভাসমান স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০০ এমএমসিএফ/ডি এলএনজি আমদানি করছে।

এ কারণে গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস খোঁজা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস আবিষ্কার

বঙ্গোপসাগরে যে বিপুল তেল ও গ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা আছে, তা গত দুই দশক ধরে ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার থেকেই স্পষ্ট।

ভারত এখন পর্যন্ত অনেকগুলো কূপ খনন করে মোট ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কার করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কূপটি কৃষ্ণ-গোদাভরী অববাহিকায় অবস্থিত ধীরুভাই ডিপ ওয়াটার ব্লকে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত এই কূপে ২৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে। এখান থেকে ২০০৯ সাল হতে প্রতিদিন ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন করা হচ্ছে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে ২০০৫ সালে আবিষ্কৃত ২-৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের দীনদয়াল গ্যাসক্ষেত্র।

এরপর আরও আটটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে ভারত। মাহান্দি বেসিনে ভারত ৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়েছে। তবে ভারত বেঙ্গল অববাহিকাতেও ৪০টি কূপ খনন করেছে। এই অঞ্চলে দেশটি কোনো গ্যাসক্ষেত্র পায়নি।

অন্যদিকে মায়ানমার ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মোট ৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট থেকে ১০ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।

গত দশকে আমেরিকান কোম্পানি কনোকোফিলিপসের কাছ থেকে গভীর সমুদ্রে একটি অনুসন্ধানমূলক তেল ও গ্যাস কূপ খননের প্রস্তাব পায় বাংলাদেশ। কনোকোফিলিপস একটি চুক্তির আওতায় ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে একটি সিসমিক সার্ভে করে এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে কূপ খননের প্রস্তাব দেয়।

কোম্পানিটি ৫ থেকে ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার আশা করেছিল। কিন্তু এই পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল মাত্র ১৭ শতাংশ। এছাড়াও কোম্পানিটি বেশ কিছু আর্থিক শর্ত আরোপ করেছিল। সরকার সেগুলো মেনে নেয়নি। তাই কনোকোফিলিপস ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে চলে যায়।