নিজস্ব সংবাদদাতা :  ১৫৪ বার “DHOOM 3” মুভি দেখে বগুড়ার ১৬ বছর বয়সী কিশোরের ব্যাংক ডাকাতি করার খবর জানায় বগুড়ার পুলিশ।

আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির বিষয়ে মাথায় সব অবিশ্বাস্য জ্ঞান। তার সব কীর্তি শুনলে গা শিউরে উঠবে। বিশ্বের বড় বড় সাইবার অপরাধীর সঙ্গে রয়েছে তার সম্পর্ক। ভুয়া ৫২টি ফেসবুক আর ২২টি ই-মেইল আইডি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত তার অপরাধের নেটওয়ার্ক। আর ডার্ক ওয়েব জগতের নিষিদ্ধ পথগুলিও তার চেনা।

হোয়াইট ডেভিল নামের হ্যাকিং গ্রুপের এই ক্লেভার বয় বগুড়া শহরের বিস্ময়কর বালক কৌশিক! যেমন সুদর্শন, তেমন তুখোড় মেধাবী। অ্যাডভেঞ্চারে ছেলেটির দারুণ নেশা। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করে আনা।

বগুড়ার গাবতলীর একটি ব্যাংক ডাকাতির দুর্বৃত্ত খুঁজতে গিয়ে পুলিশ আবিষ্কার করেছে এই কিশোরকে। ওই ডাকাতির বেশ কিছু দিন পর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় কৌশিক ( এখানে তার প্রকৃত নাম ব্যবহার করা হয়নি)। তার বয়স সবে মাএ ১৬ বছর। এই বয়সেই অপরাধ জগতের নানা পর্যায়ে ঘুরে ফেরা এই কিশোর নিজ মুখেই জানায়  তার ভয়ংকর সব কর্মকান্ডের কথা। পিলে চমকানো এসব তথ্য জেনে শুধু হতভম্বই নয়, আতঙ্কিতও হয় বগুড়া পুলিশের অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও।

কে এই কৌশিক

বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা কৌশিকের। পড়াশোনার পাশাপাশি সে স্কাউটিং, বিএনসিসি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তথ্য-প্রযুক্তিতে দারুণ দক্ষ। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ডসহ রাজশাহী বিভাগের সেরা স্কাউটের খেতাব অর্জন করেন কৌশিক। তার বাবা বগুড়া শহরের নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী। বাড়ি শহরতলীর মাটিডালি এলাকায়। তার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে বগুড়ার গাবতলীতে। সেই টানে কৌশিক প্রায়ই গাবতলী যেত। আর এ কারণেই সেখানকার ব্যাংকে ডাকাতির চিন্তা মাথায় আসে তার।

গাবতলীর ডাকাতি ছিল কৌশিকের অ্যাডভেঞ্চারের একটি অংশ। যার জন্য অত্যাধুনিক ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসে তৈরি বলিউডের মুভি ‘Dhoom-3’ গুনে গুনে ১৫৪ বার দেখে পরে সে নিজেকে প্রস্তুত করে এবং ঐ কিশোরের ব্যাংক ডাকাতি করার ইচ্ছা জাগে। যদিও ওই ছবির দৃশ্যে ঝুঁকি থাকায় সিনেমার শুরুতেই সতর্কবাণী জুড়ে দেয় সেন্সর বোর্ড। ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস (ভিএফএক্স) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে চিত্রগ্রহণটি চলচ্চিত্র তৈরির একটি লাইভ-অ্যাকশন শটের প্রেক্ষাপটের বাইরে তৈরি করা হয়। যা (ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস) বেশির ভাগ বিনোদন শিল্প, সিনেমা, টিভি শো ও গেমে ব্যবহার করা হয়।

‘Dhoom-3’ থ্রিলার ছবিতে সর্বাধুনিক ভিএফএক্সের মাধ্যমে দুঃসাহসিক সব ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে অভিনয় করেন বলিউড কিং আমির খান। সেখানে ই-বাইক (যা মাটি ও পানিতে চলতে সক্ষম) ব্যবহার করে ডাকাতির দুঃসাহসিক দৃশ্য ছবিতে তুলে ধরা হয়। মূলত এই ছবি দেখে এবং সাইবার অপরাধে বিচরণ করে বেড়ানো কৌশিকের সাধ জাগে ব্যাংক ডাকাতির ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারের।

৫ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলী এলাকায় রূপালী ব্যাংকের একটি শাখার দুই নিরাপত্তারক্ষীকে ছুরিকাঘাত ও দাহ্য পদার্থ ছুড়ে ঘায়েল করে ডাকাতির চেষ্টা করে এই কৌশিক। মুখোশ পরা অবস্থায় সে নিক্ষিপ্ত দাহ্য পদার্থ ও ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দুই আনসার সদস্যকে। ওই দিন ভোরে সে মুখোশ এবং হাতে বিশেষ রুফটপ গ্লাভস পরে প্রথমে ছাদে ওঠে। এই গ্লাভস ব্যবহার করলে স্পাইডারম্যানের মতো দেয়ালে উঠতে মই ব্যবহার করতে হয় না। এরপর কাটার দিয়ে ছাদের সিঁড়িঘরের তালা কেটে ভেতরে ঢোকে কৌশিক। শেষে ব্যাংকের ভেতরের ভল্ট ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। ঘটনার ১৮ দিন পর গাজীপুরের টঙ্গীতে তার চাচার বাড়ি থেকে কৌশিককে গ্রেফতার করে বগুড়া পুলিশের একটি বিশেষ দল।

কৌশিক পুলিশকে জানায়, সে ডার্ক ওয়েব থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্যাংক ডাকাতির সময় সেখানে পাহারারত আনসারের গায়ে নাইট্রোজেন সলিউশন ছুড়ে মারে। এটি শরীর পুড়ে ফেলার পাশাপাশি প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি করে। নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো এই এসিডও কৌশিক তার নিজের ল্যাবে তৈরি করে বলে জানায়। এ ছাড়া সে ব্যাংকের দেয়াল ও মেঝের ওপর এসিটোন আল অ্যালকাইন সলিউশন ঢেলে দেয়। যাতে দেয়াল ও মেঝে পিচ্ছিল হয়ে যায়।

বিশ্ব কাঁপাতে চেয়েছিল কৌশিক

DHOOM 3 মুভি দেখে কিশোরের মনে ব্যাংক ডাকাতি করার সখটা খুব বেশি জেগে ওঠে ।ডার্ক ওয়েব সাইটে অবাধ বিচরণ ছিল কৌশিকের। ডার্ক ওয়েব ইন্টারনেটের এমনই এক অংশ, যেখানে কোনো সার্চ ইঞ্জিন, সাধারণ ব্রাউজার এক্সেস নিতে পারে না। ওই ওয়েবে নিজের পরিচয় পুরোটা লুকিয়ে ঢোকা যায় বলে সেখানে অনাসায়েই সর্বোচ্চ অপরাধ ও নিষিদ্ধ কাজ করা সম্ভব হয়।

ডার্ক ওয়েবে হোয়াইট ডেভিল নামে একটি হ্যাকিং গ্রুপের মাধ্যমে কৌশিকের ইচ্ছা ছিল বিশ্বের শীর্ষ অপরাধীদের খাতায় নাম লেখানো। এ কারণে সে একটি আন্তর্জাতিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে রাশিয়া থেকে  পারক্লোরিক এসিড, ক্লোরোফম, এডিনল ইথানল ও পটাশিয়াম ডাইক্লোরেট নামের বিভিন্ন ভীতিকর রাসায়নিক পদার্থ এনেছিল। নিজের বাড়িতে বসে সে তার ব্যক্তিগত ল্যাবে এসব নিয়ে গবেষণা করতো।

এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ‘Dhoom-3’ ছবিতে ব্যবহৃত ই-বাইক, অত্যাধুনিক সার্ভেইল্যান্স টুলস চীন থেকে অর্ডার করেছিল। বাংলাদেশ কাস্টমসের অনুমতি না মেলায় সেগুলো কৌশিকের হাতে আর পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তার সংগ্রহে ছিল বিভিন্ন সার্ভেইল্যান্স ইকুইপমেন্ট, নাইফ ও ভেস্ট যা ব্যবহার করেন পুলিশের বিশেষ দল ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া সে বাংলাদেশি একটি ই-কমার্স সাইট থেকে কিনে নেয় ট্রেসার গান। হাইভোল্টেজ তৈরি করা এই গান ব্যবহার করে যেকোনো মানুষকে প্রতিহত করা সম্ভব বলে জানায় বগুরা পুলিশ।

নিউক্লিয়ার সাইন্স নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ ছিল কৌশিকের। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে সে নিষিদ্ধ অনেক ধরনের বই সংগ্রহ করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল  Brittanica, The light USA, The unknown, The versa, La diaga, Critix। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কৌশিক জানায়, নিউক্লিয়ার সায়েন্সের ওপর পড়াশোনা করতে গিয়ে তাকে রাশিয়ান ভাষা শিখতে হয়েছে।

একই সঙ্গে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির জন্য সে থিসিস নোট লিখে ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে জমা দিত আর তার একটি ২৩ পাতার আর্টিকেল ও তিন পাতার নকশা ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে আট হাজার ডলারে বিক্রি হয়। বাংলাদেশি টাকায় যা সাড়ে সাত লাখেরও বেশি। দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকে তার মায়ের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কৌশিক এই টাকা তুলে নেয়।

এর পর ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেই তার কাছে আরো কিছু থিসিস মেটার নেওয়ার চাহিদা আসে। থিসিস নোট থেকে পাওয়া টাকার পুরোটাই সে ব্যয় করে অন্ধকার জগতের অ্যাডভেঞ্চারের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। নতুন কিছু জানতে সাইবার অপরাধীদের সঙ্গে কাটিয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কৌশিক পুলিশকে জানায়, সে সেনা কমান্ডোর মতোই নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম। মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে এসির কনভার্টার রিম দিয়ে তৈরি করতে পারে বিপজ্জনক দোনলা বন্দুক। একই সঙ্গে এসির কমপ্রেশারের গ্যাস দিয়ে তৈরি করতে পারে চেতনানাশক গ্যাস। যা স্প্রে করলে যে কেউ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জ্ঞান হারাবে।

কৌশিকের আরও একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার হলো বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রিত ইনস্ট্যান্ট ফায়ার সলুশন। এটি তরল পদার্থ, যা দিয়ে মাটি, বালি, পানি, কংক্রিটসহ যেকোনো বস্তুর ওপর আগুন জ্বালানো সম্ভব। এই ইনস্ট্যান্ট ফায়ার ব্যবহার করে একই ব্যাংকে সে দুই-তিন মাস আগে আরেকবার আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেছিল বলে জানায় সে।

ছেলেবেলা থেকেই তার আগ্রহ সাইবার অপরাধে। কয়েক বছর আগে ডার্ক ওয়েবে পাওয়া একটি লিংকের মাধ্যমে কৌশিক বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি মোবাইল ফোনের প্রধান সার্ভার হ্যাক করে। কৌশিকের দাবি, তার হ্যাকিংয়ের গ্যাঁড়াকলে পড়ে ওই ফোন কম্পানি আট ঘণ্টা তাদের প্রধান সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল।

বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূইঞা বলেন, ছেলেটির কীর্তিতে সত্যিই আমরা অবাক! এই বয়সে এত বড় বড় অপরাধ পরিকল্পনা, ভাবাই যায় না!’ তিনি বলেন, তাকে ধরতে বগুড়া পুলিশের বিশেষ দলকে রীতিমতো ঘাম জড়াতে হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বে গাবতলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন ১৮ দিন চেষ্টার পর তাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

পুলিশ জানায়, একজন পেশাদার অপরাধীর চেয়েও চতুরতা বেশি নিয়েছিল কৌশিক। পিঠে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ডাকাতিতে ব্যর্থ হয়েছিল সে। পরে সে বগুড়া শহরে এসে তার এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে সে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছদ্মনাম ব্যবহার করে চিকিৎসা নেয়। এরপর বাসে করে পালিয়ে চলে যায় গাজীপুরের টঙ্গীতে তার চাচার বাসায়। সেখানে সে তার সব অনলাইন যোগাযোগ বন্ধ রেখে গোপনে ই-পাসপোর্ট করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।

কিন্তু প্রতি রাতে তার এক মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে চ্যাটিং তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। শুধু এই একটি সূত্র ধরে পুলিশ এই ভয়ংকর বালককে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।

গ্রেপ্তারের পর তার পরিবারের কেউ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। গত শুক্রবার ভোরে গ্রেপ্তারের পর ওই দিন সন্ধ্যায় কৌশিককে হাজির করা হয় বগুড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আসমা মাহমুদের আদালতে। সেখানে সব ঘটনার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় সে। পরে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পুলিশ জানায়, বয়সের কারণে কৌশিককে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হতে পারে।

এ ব্যাপারে কৌশিকের মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, ছেলে মেধাবী হলেও বখে গেছে। তাদের কথা শোনে না। তারা ছেলের অপরাধের ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।