২০২১ আন্তর্জাতিক নৌ দিবসের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ১১:৩৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১
লাইট হাউজ ফাইল ফোটো

সম্পাদকীয়: প্রতি বছরের সেপ্টম্বর মাসের শেষ বৃহস্প্রতিবার দিনটি পালন করা হয়। মেরিটাইম শিল্প ও এর সাথে নিযুক্ত সকলের সচেতনতা এবং এর উন্নয়নের জন্যে এটি একটি প্রতিকী উদ্যোগ। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এ বছরের দিবসটিকে নাবিকদের প্রতি উৎসর্গ করে বলেছেন “ সমুদ্রের নাবিকরাই হলো এই মেরিটাইম শিল্প চালনার প্রধান বা মূল চালিকা শক্তি।” ৩০ শে সেপ্টম্বরের ঐ দিনটিতে নীল রং এর আলোতে আলোকিত হবে লন্ডনের আই এম ওর প্রধান দপ্তর।
গেল বছরের তাঁদের প্রতিশ্রুতিগুলোর প্রধানটি ছিল কোভিড-১৯ এর ভয়াবাহতায় দীর্ঘ দিন বাড়ী না ফেরা নাবিকদের সহায়তা প্রদান এবং দীর্ঘদিন ছুটিতে
থাকাদের কর্মে যোগদানের বিষয়টি। জাহাজ মালিক এবং জাহাজ পরিচালনাকারীগন আই এম ওর এই নিতীটি যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে পালন করেছেন। এই শুভ কর্মটি সম্পাদনের লক্ষ্যে জড়িত সকলেই প্রশংসা অর্জনের দাবীদ্বার।
আই এম ওর ২০২১ সালের প্রতিশ্রুতিটি একইসাথে জাতিসংঘ উত্থাপিত আন্তর্জাতিক টেকসই কিছু উন্নয়ন কর্মসুচীর সাথে সম্পৃক্ত। যার চতুর্থ অনুচ্ছেদ হলো: নাবিকদের প্রশিক্ষনের উন্নয়ন; অষ্টম অনুচ্ছেদ: কর্মের শালীনতা রক্ষাকরন; নবম অনুচ্ছেদ: মেরিটাইম শিল্পে নতুন মতাদর্শের প্রয়োগ; এটি সম্ভব হবে ভাবের (ideas) অর্জনের সাথে। আর অভিজ্ঞতাই হলো ভাব অর্জনের প্রধান উপাদান। পন্চম অনুচ্ছেদ: নারী ও পুরুষ নাবিকদের সম অধিকার নিশ্চিতকরন (Gender equality)।
আমাদের দেশে রয়েছে একটি বিশাল নাবিক গোষ্ঠি। এঁরা পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যথেষ্ট পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁরা চাইবেন বর্তমানের আর্থ সামাজিক অবস্থানটিকে ভবিষ্যতে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবার। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য প্রধান দায়িত্ব নাবিকের সম্পুর্ন নিজেস্ব। যদি এক কথায় বলি তাহলে প্রতিটি নাবিককে অর্জন করতে হবে পেশাদারিত্ব( professionalism)। নাবিকদের পেশাদারিত্বের অর্জন বিষয়টির সাথে প্রশাসন, প্রশিক্ষনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা, জাহাজ মালিক-পরিচালকারী-এজেন্ট সকলেরই দায়বদ্ধতা রয়েছে। যে যার অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলে হয়তো বা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের যাত্রাটির পথ শুরু হবে। নাবিকদের জ্ঞ্যান অর্জন মূলত নাবিকের ব্যক্তিগত একটি প্রধান দায়িত্ব। তবে আরেকটু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নাবিকদের পড়ালেখা বিষয়ের পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি। নাবিকদের তৈরি করা হয় শুধুমাত্র জাহাজ পরিচালনার উদ্দেশ্যে, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত জ্ঞ্যানার্জনের মাধ্যমে শুধুই একটি পরীক্ষা উত্তীর্ন হবার লক্ষ্যে। যেটিকে আমার কাছে মনে হয়েছে মানব জ্ঞ্যান সম্পদের সম্পুর্ন ব্যাবহার না করা। এতে নাবিকদের তাঁর কর্মের সামর্থ্য বিকাশের একটি সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। অনেক দেশেই নাবিকদের চাকুরীপূর্ব (pre-sea training) প্রশিক্ষনটি চার বছরের। শুধুই পেশাগত সম্পর্কীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ভাষা শিক্ষা সহ নানান জ্ঞ্যানের শিক্ষা দেয়া হয় যা একটি পরিপূর্ন পেশাগত জীবনের জন্য আবশ্যক। আশার কথা এই যে, আমাদের দেশেও বর্তমানে নাবিকেদের গ্রাজুয়েশন (সন্মান)পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে দুবছরের pre-sea ট্রেনিংটি যথাযথ জ্ঞ্যান অর্জনের জন্য নানাবিধ কারনে পূর্নতা পায়না। এরপর একবছরের অনবোর্ড ট্রেনীংটি অনেকাংশেই সঠিক ভাবে করা হয়না। এটি শেষ করলেই নাবিক ব্যাচেলর অফ মেরিটাইম সায়েন্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। তারপর শুধুমাত্র সিওসি পরীক্ষার পাশের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। পূর্নাংগ জ্ঞ্যান অহোরন বা পেশাদারিত্ব অর্জনের লক্ষ্যে এই পদ্ধতিগুলোর সাথে নতুন মাত্রা যোগ করা যেতে পারে। পাঠ্যক্রমের কর্মসুচীর বিষয়টি পরির্তন বা পরিবর্ধন করা যেতে পারে।ভালো মানের (Quality) নিশ্চয়তা পেতে গেলে শক্ত ভীতের (Basic foundation) প্রয়োজন সর্বপ্রথম।

নাবিকদের ওয়ার্ক রেষ্ট আওয়ার নিয়ে কিছু কথা বলি। এক সময় জাহাজ চলতো অনেক নাবিক পরিবেষ্টিত হয়ে। স্বল্প সংখক জাহাজ ছিল। পরিবহনের পন্য ছিল অনেক। পরবর্তিতে জাহাজ ব্যাবসায়িদের দল ভারি হলে আর তেলের( ১৯৭৩ এর আরব-ইসরাইল যুদ্ধ পরবর্তী সময়) দাম বৃদ্ধি পেলে প্রয়জোন হয় জাহাজের চলতি মূলধন হ্রাসের। ফলস্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে উদ্ভাবিত জাহাজের অটোমেশন (সে সময় টেকনোলোজি বলতে ওটুকুই ছিল) থেকে কিছুটা উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে নাবিকদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হতে থাকে। কিন্ত স্বল্প সংখক নাবিকদের কাজের বোঝা দীর্ঘায়িত হয় এবং পরিনতিতে নাবিকদের ক্লান্তি( fatigue )সৃস্টি করে যা অনেক দুর্ঘটনার, জীবন ও সম্পদের ওপর এটি একটি ঝুঁকির প্রভাব ফেলে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় শরীর এবং মনকে কাজের উপযুক্ত রাখার জন্য ক্লান্তি (fatigue) একটি প্রধান অন্তরায়। আর ক্লান্তি মানেই দুর্ঘটনা। জান মালের ক্ষতি। পরবর্তিতে জাহাজ মালিক আর পরিচালনাকারিদের অগ্রনি ভুমিকার ফলাফল হলো ওয়ার্ক-রেষ্ট আওয়ার পলিসি। এটি STCW-2010 কনভেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়। এতে মেরিটাইম শিল্পের সমস্ত উদ্যোগতাদের স্বার্থ নিশ্চীত হলেও নাবিকদের জন্যে এটি বিতর্কিত। এর ব্যত্যয় ঘটলে নাবিকদের নিজেদেরই জবাবদিহী করতে হবে। একবার একটি ফ্ল্যাগ স্টেট ইনসপেকশনে বলা হলো তোমাদের ওয়ার্ক রেষ্ট আওয়ারটির ব্যত্যয় ঘটেছে। আমি বলেছিলাম আপনারা যদি আপানাদের সেফ ম্যানিং সার্টিফিকেটটার একটু পরিবর্তন করে দেন তাহলে এটি আর হবেনা।
অপ্রিয় হলেও সত্য পশ্চিমের মালিক পক্ষ যখন পশ্চিম দেশের নাবিক দিয়ে জাহাজ পরিচালনা করেন তখন এর ব্যত্যয় ঘটাটা মোটামুটি অস্বাভাবিক, একই মালিক যখন এশিয়ার নাবিকদের নিযুক্ত করেন তখন বাস্তবিকতায় এর ব্যত্যয় ঘটলেও কাগজে কলমে তা প্রকাশিত হয়না এবং এটি সমস্ত স্টেক হোল্ডারদেরই গোচরীভুত। এতে করে কি ক্লান্তি আসেনা, দুর্ঘটনা ঘটেনা ? অবশ্যই ঘটে। তবে সেক্ষেত্রে নিরীহ নাবিকটিই হয় পরিস্থিতির শীকার।
যাই হোক ২০২১ সালের বিশ্ব নৌ দিবসে আমার আমার নিজেস্ব চাওয়া হলো “ সমস্ত নাবিকদের কাজ এবং বিশ্রামের নিশ্চয়তাটি বাস্তবিক ভাবে আরোপিত হউক।”
তথ্যসূত্র: imo website.

সুস্থ ও নিরাপদে থাকুন

আন্তর্জাতিক নৌ দিবসে নাবিকের প্রত্যাশা

আন্তর্জাতিক নৌ দিবসে নাবিকের প্রত্যাশা

চীফ ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান