ডেঙ্গু মশা দেখতে কেমন, কামড়ালে কী ফুলে যায়?

প্রকাশিত: ৪:১৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০২৩

চলতি মাসে ডেঙ্গুতে প্রায় ১৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৪০০ ছুঁই ছুঁই। ডেঙ্গুতে এমন মৃত্যুর হারে সবার মাঝেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ডেঙ্গু মশা যে আর দশটা মশার মতো সাধারণ নয় তাও সবাই টের পেয়ে গেছেন। এ মশা দেখতে কেমন, কীভাবে কামড়ায় এমন নানা প্রশ্নের উত্তর সবাই জানতে চান।

এ নিয়ে বিবিসি বাংলা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করায় ডেঙ্গু জ্বর এবং এর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার তথ্য চানতে জনমনে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

‘ডেঙ্গু মশা’ কামড়ালে কি ফুলে যায়? এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমটিতে বলা হয়েছে, যদিও ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশার নাম এডিস এজিপ্টি, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মশা ‘ডেঙ্গু মশা’ নামেও পরিচিত। ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশা কামড়ালে, ওই স্থানটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছুটা ফুলে যায় এবং চুলকায়। তবে অনেকের ক্ষেত্রে মশা কামড়ানো সত্ত্বেও ফুলে যাওয়া বা চুলকানি কোনটি নাও হতে পারে।

তবে মশা রক্ত খাওয়ার জন্য যখন হুল ফোটায় তখন বেশিরভাগ মানুষ তা টের পান না। এর কারণ মশা হুল ফোটানোর আগে কিছুটা ব্যথানাশক ঘন তরল মানুষের ত্বকের ভেতর ছড়িয়ে দেয়। এতে কিছুক্ষণের জন্য ত্বকের ওই অংশটি অবশ হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর অবশ ভাব চলে গেলে ত্বকের ওই জায়গা একটু চুলকায় এবং ফুলে যায়। সংবাদ মাধ্যমটিতে কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার জানান, এডিস মশা কামড়ালে ক্ষতস্থানটি একটি মোটর দানার সমান বা তার চেয়ে কিছুটা অল্প জায়গা জুড়ে ফুলে যেতে পারে।

তাই মশার কামড় থেকে বাঁচতে হাত ও পা ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া দিনে-রাতে মশারি ব্যবহার, দরজা জানালায় মশারোধী নেট ব্যবহার, সেইসাথে মশা নিরোধক ক্রিম, স্প্রে, প্যাচ ব্যান্ড ব্যবহার করা যেতে পারে।

একসময় বলা হতো ডেঙ্গু মশা শুধুমাত্র দিনের বেলা কামড়ায়। কিন্তু এডিস মশা সম্প্রতি তাদের চরিত্র বদলেছে। এখন দিনে রাতে সব বেলাতেই কামড়াতে পারে এডিস এজিপ্টি, বিশেষ করে রাতে যদি ঘর আলোকিত থাকে।

‘ডেঙ্গু মশা’ দেখতে কেমন? এ প্রশ্নের উত্তরে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশা খালি চোখে দেখেও শনাক্ত করা সম্ভব।’ তিনি জানান, মশাটি মাঝারি আকারের হয়ে থাকে এবং এর গায়ে-পায়ে সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে।

তবে আর্মিগিয়ার নামে একটি মশার পেটেও একই ধরণের ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। তবে, এ মশাটি আকারে একটু বড় হয়। অনেকে এই মশাটিকে এডিস অ্যাজিপ্টি বলে ভুল করে। আপনাকে যে মশা কামড়েছে সেটি এডিস কিনা নিশ্চিত হতে মশাটির পায়ের দিকে লক্ষ্য করতে হবে। শুধুমাত্র এডিস মশার পায়েই ডোরাকাটা দাগ থাকে। এছাড়া পুরুষ মশার অ্যান্টেনা বা শুঙ্গটি কিছুটা রোমশ হয়ে থাকে। স্ত্রী মশার এমনটা থাকে না।

মশা কামড়ালেই কি ডেঙ্গু হবে? এডিস মশা কামড়ালেই যে মানুষের ডেঙ্গু জ্বর হবে, বিষয়টি তেমন নয় বলে জানিয়েছেন ড. কবিরুল বাশার। তবে যে এডিস মশাটি ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহন করছে, সেটি কামড়ালে ডেঙ্গু হতে পারে। আবার কোন সুস্থ এডিস মশা যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে রক্ত পান করে তাহলে মশাটির মধ্যে ডেঙ্গুর ভাইরাস সংক্রমিত হবে। এরপর ওই ভাইরাসবাহী মশা সংক্রমিত থাকা অবস্থায় যদি আবার সুস্থ কোন মানুষের শরীরে কামড়ায় তাহলে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে।

যেকোন মশার মতই এডিসও সাধারণত একাধিক ব্যক্তিকে কামড়ায়। তাই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির শরীর থেকে এডিস মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর ঐ মশার কামড়ে ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ চক্র
মশা কামড়ানোর পর কী করলে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে? মশা কামড়ালে সেটি রক্তের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তেমন কিছু করার থাকে না বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার।

তবে মশা কামড়ানোর পর ভাইরাসটি যদি শুধুমাত্র চামড়ার ওপরে লেগে থাকে তাহলে ওই স্থানটি ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে ধুলে ভাইরাস মরে যাবে। তবে একবার রক্তের সাথে ভাইরাস মিশে গেলে কোন কিছুই কাজ করবে না।

ডেঙ্গু মশা কোথায় থাকে, কোথায় ডিম পাড়ে?
এডিস মশা সাধারণত শুকনো ছায়াযুক্ত নিরাপদ স্থানে বিশ্রাম নেয়। এই মশাটি যেকোনো জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে। সাধারণত পাত্রের কিনারার দিকে ডিম পেড়ে থাকে।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘এই ডিম ফুটে লার্ভা হয়, লার্ভা থেকে পিউপা হয়, পিউপা থেকে হয় পূর্ণাঙ্গ মশা’। জমে থাকা পানি পরিষ্কার বা নোংরা কিনা সেটা বিষয় নয়। পানিটি টানা কয়েকদিন স্থির থাকলে সেখানে ডিম ছাড়তে পারে এডিস মশা। এক সময় বলা হতো এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে বংশ বিস্তার করে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় সেই বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন দেখা গিয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অভিযানে পুরোন টায়ার, ড্রাম, বালতি বা ফেলে দেয়া বোতল বা পাত্র, নারিকেলের খোলে জমা পানি, চৌবাচ্চা, নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, ইটের গর্ত এমনসব স্থানে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। সাধারণত জমা পানি ফেলে দিলে কিংবা ওই পানিতে সাবান বা ব্লিচিং মেশানো পানি ছিটিয়ে দিলে মশার ডিম ধ্বংস হয়ে যাবে।।

ডেঙ্গু জ্বর কতদিন থাকে?
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে- ক্লাসিকাল এবং হেমোরেজিক। ক্লাসিকাল ডেঙ্গু সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। সর্বোচ্চ ১০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, সাধারণত জ্বর সারার পরপরই অনেকের প্লেটলেট এবং রক্তচাপ কমতে শুরু করে।

কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে জ্বরের তিনদিনের মধ্যেও প্লেটলেট কমতে দেখা গেছে। যদিও প্লেটলেট একবার কমার পর সেটি ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। তবে কেউ যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক শক সিন্ড্রোমে চলে যান তাহলে তাহলের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

এক্ষেত্রে একেক রোগীর সেরে উঠতে একেক রকম সময় লাগবে, নির্ভর করে রোগীর কোন অঙ্গে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এক্ষেত্রে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও সময় লাগতে পারে। “মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে সময় বেশি লাগবে আবার কিডনি বা লিভারের সময় অপেক্ষাকৃত কম লাগবে।” বলেন অধ্যাপক ঘোষ।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণসমূহ
জ্বর। শরীরে ব্যথা বিশেষত জয়েন্টে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা। শরীরে লালচে র‍্যাশ। পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া। বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া। কাশি। ক্ষুধামন্দা। অস্বাভাবিক দুর্বলতা, ক্লান্তি। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ (মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, কালো রঙের পায়খানা, মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত)। রক্তচাপ কমে যাওয়া, পালস রেট বেড়ে যাওয়া। এখন যেহেতু ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি, ডেঙ্গুর ধরনও বারবার পরিবর্তন হচ্ছে। তাই কারো জ্বর হলে ডেঙ্গুর লক্ষণের অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। সূত্র: বিবিসি বাংলা।