ডিজিটাল উন্নয়নের ছোঁয়ায় বেগবান সরকারি শিপিং অফিস

প্রকাশিত: ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২০

স্টাফ রিপোর্টার: বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন ব্যবস্থার বিকাশ ও উন্নয়নে সরকার সচেষ্ট রয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। নৌ প্রতিমন্ত্রী লাইট হাউজ নিউজকে বলেন, বাংলাদেশি নাবিকদের নির্বিঘ্নে বিদেশী জাহাজে যোগদান এবং বিভিন্ন বন্দরে গমনের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সীফ্যায়ারার আইডেন্টি ডকুমেন্ট(এসআইডি) এবং মেশিন রিডেবল সীম্যান বুক(সিডিসি) প্রবর্তন এবং যুগোপযোগীকরন সহ বাংলাদেশী সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের সিডিসি, যোগ্যতার সনদ, সার্টিফিকেট অফ প্রফিশিয়েন্সি অনলাইন যাচাই এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাল সিডিসি ও যোগ্যতার সনদ রোধকল্পে নিরাপত্তা ছাপ সম্বলিত যুগোপযোগী সিডিসি ও সনদ দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় জাহাজ কোম্পানী গুলোর সাথে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে দফায় দফায় বৈঠক করা হয়েছে, এবং ঐ সমস্ত কোম্পানিতে বাংলাদেশি নাবিক নিয়োগ এর ব্যাপারে সরকার অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্ম তৎপরতায় এবং প্রচেষ্টায় বিশেষ করে মহাপরিচালক জনাব কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম (ট্যাজ), এনডিসি, পিএসসি, বিএন এর তত্ত্বাবধানে, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, ঢাকা, মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্ট চট্টগ্রাম এবং সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস, চট্টগ্রাম এর ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড চোখে পড়ার মতো। সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস, চট্টগ্রাম নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একটি অধীন্যস্ত অফিস। দেশী-বিদেশী সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিক, ক্যাডেট, অফিসারদের অনুকূলে সিডিসি (Seaman’s Book-Continuous Discharge Certificate) ইস্যু, তাদের জাহাজে চুক্তিপত্রে সাইন অন/সাইন অফ, নাবিকদের পদোন্নতি, শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য বানিজ্যিক নৌপরিবহন আইন-১৯২৩ এর ধারা-০৬ এর বিধান অনুসারে ১৯৪৮ সালে সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস, চট্টগ্রাম স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই অফিস বাংলাদেশ মার্চেন্ট শিপিং অধ্যাদেশ-১৯৮৩ এবং উহার অধীনে প্রণিত বিধিবিধান,সরকারী আদেশ-নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস, চট্টগ্রাম এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দেশী বিদেশী সমুদ্রগামী বানিজ্যিক জাহাজে বাংলাদেশী সীফ্যারারদের নিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য দেশী বিদেশী জাহাজ মালিক/ নাবিক রিক্রুটিং এজেন্টদের সহায়তা প্রদান করা। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বৈশ্বিক মেরিটাইম সেক্টরে বাংলাদেশী সীফ্যারারদের অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে।
সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস, চট্টগ্রাম এ যোগাযোগ করে জানা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা নিজস্ব ওয়েবসাইট www.gso.gov.bd ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে চালু করে। উক্ত ওয়েবসাইটে বাংলাদেশী সীফ্যারারদের হালনাগাদ তথ্যাদি সন্নিবেশিত আছে। জুন-২০১৯ হতে ওয়েবসাইটটি জাতীয় তথ্যবাতায়নের সাথে সংযুক্ত। এই ওয়েবসাইটে সীফ্যারার, নাবিক রিক্রুটিং এজেন্ট, সিডিসি যাচাই, অনলাইনে জাহাজের আগমনী ও বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু সুবিধা সহ বিভিন্ন জরুরী নোটিশ, বিজ্ঞপ্তি ও সংবাদ প্রচার করা হয়। উক্ত ওয়েবসাইটের সাথে সীফ্যারারদের হালনাগাদ ডাটাবেইজ তৈরী করা হয়েছে। এর ফলে দেশী-বিদেশী জাহাজ মালিক/স্থানীয় ম্যানিং এজেন্ট,বিভিন্ন দুতাবাস,ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সহজেই উক্ত ডাটাবেইজ থেকে সীফ্যারারদের সিডিসি যাচাই করতে পারছে। এতে করে জাল জালিয়াতি বন্ধ হওয়ায় বৈধ নাবিকদের চাকুরীর সুয়োগ সৃষ্টি হয়েছে। ১৫-০১-২০১৭ সাল হতে অনলাইনে সীফ্যারারদের জাহাজে সাইন অন-অফ কার্যক্রম চালু আছে। অনলাইনে সাইনঅনের ক্ষেত্রে সীফ্যারারকে শিপিং অফিসে উপস্থিত হতে হয়না। সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস তাদের অফিসিয়াল ইমেইল gso@gso.gov.bd, dsm@gso.gov.bd, asm@gso.gov.bd সমূহ ব্যবহার করে দ্রুততার সাথে তথ্য আদান/প্রদান ও সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। ই-গভর্নেন্স কর্মসূচী বাস্তবায়নে শিপিং অফিসে ই-নথি কার্যক্রম চালু আছে। ০৯-১১-২০১৭ খ্রিঃ তারিখ হতে QR code সমৃদ্ধ দশ বছর মেয়াদী বিশেষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য যুক্ত মেশিন রিডেবল সিডিসি ইস্যু করছে‌ শিপিং অফিস। এল.ই.ডি ডিসপ্লে নোটিশ বোর্ডের মাধ্যমে সীফ্যারারদের সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। রোস্টার শাখায় সীফ্যারারদের জন্য ১টি ডাটা বেইজ তৈরী করা হয়েছে, এতে করে কোন কোম্পানীতে/রোস্টারে কতজন এবং কোন পদে কতজন সীফ্যারারে আছে তা সহজেই বের করা যাচ্ছে। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের এই দুর্যোগকালীন সময়ে বিগত ১৬-০৪-২০২০ খ্রিঃ তারিখ হতে শিপিং অফিস অনলাইনে জাহাজের আগমনী ও বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যুর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ফলে কোন জাহাজ মালিক/শিপিং এজেন্টকে NOC এর জন্য শিপিং অফিসে আসার প্রয়োজন পরে না। ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রিঃ মাস হতে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সমগ্র বিশ্বের অন্যান্য সেক্টরের মতো মেরিটাইম সেক্টরও আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের দেশের মেরিটাইম সেক্টরেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। চীনে প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই লকডাউন শুরু হওয়ায় আমাদের অনেক সীফ্যায়ারার সাইন অন করার পরও জাহাজে যোগদান করতে পারেনাই এবং সাইন অন বাতিল করতে হয়েছে। পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বেই এর সংক্রমন ছড়িয়ে পরলে বিভিন্ন দেশ লকডাউন করে এবং আন্তঃদেশীয় চলাচল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেশেও সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে বিভিন্ন জাহাজে সীফ্যারারগন একদিকে চুক্তি সমাপ্ত হবার পরেও সাইন অফ করে দেশে ফিরতে পারছেন না, অন্যদিকে সাইন অন করে অনেক সীফ্যারার জাহাজে যোগ দিতে পারছেন না। একই সাথে দীর্ঘ সময় জাহাজে কাজ করার ফলে অনেক সীফ্যারার অসু্স্থ হয়ে পরছে। এর প্রভাব সমগ্র শিপিং কমিউনিটিতে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ভাইরাসটির সংক্রমন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় ২৬-০৩-২০২০ খ্রিঃ তারিখ হতে সাধারন ছুটি ঘোষনা করে এবং কয়েক দফায় তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০-০৫-২০২০ খ্রিঃ তারিখ পর্যন্ত বলবৎ করা হয়েছে। এই সময়ে সংক্রমন প্রতিরোধে সবাইকে ঘরে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমনের শুরু থেকেই শিপিং অফিস সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত অনুসরন করে তার সীমিত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যেমন- দেশী বিদেশী জাহাজের আগমন -বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু,শুধু চট্টগ্রাম বন্দরে জরুরী সাইন অন-অফ, বিদেশী ও স্ক্র্যাপ জাহাজ হতে বিদেশী নাবিকদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, নাবিক সিলেকশন, রোস্টার পরিবর্তন, জরুরী সিডিসি ইস্যু, মেডিকেল এন্ডোর্সমেন্ট ইত্যাদি। অন্যদিকে সীফ্যারারদের নিরাপত্তা বিবেচনা করে জাহাজ হতে নামার এক মাসের মধ্যে সাইন অফ করার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে।
সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস শুরু থেকেই সীফ্যারারদের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কাজ করছে। মেরিনাররা যখনই কোনো অভিযোগ দাখিল করেছে, অত্র অফিস সেই বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেছে। শিপিং অফিসের কার্যক্রম প্রতিনিয়ত মেরিনারদের জন্য ডিজিটাল ও সহজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাই মেরিনারদের নিকট শিপিং অফিসের কিছু প্রত্যাশা আছে। শিপিং মাস্টার জনাব জাকির হোসেন চৌধুরী, বাংলাদেশ মেরিনাস প্লাটফম(বিএমপি) এবং নাবিকের আড্ডা নামক মেরিন কমিউনিটি ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, আপনারা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের পূর্বে অবশ্যই তা ভালোভাবে পড়ে, বুঝে তারপর স্বাক্ষর করবেন। চুক্তিকালীন সময়ে বা জাহাজে অবস্থানের সময় আপনার কোনো অভিযোগ থাকলে বা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তা বিস্তারিত ইমেইল করে ডিজি শিপিং এবং আমাদের জানাবেন। চুক্তি মোতাবেক আমরা আপনার অভিযোগ বা সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে এজেন্টের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। কোনো অবস্থাতেই আপনারা অযথা জাহাজে ITF/PSC CALL বা জাহাজ থেকে পালাবেন না বা কোনো অপ্রীতিকর আচরন করবেন না, এতে করে বাংলাদেশী মেরিনারদের সুনাম ক্ষুন্ন হবে। জাহাজ মালিক বাংলাদেশ থেকে নাবিক নেয়া বন্ধ করবে। আমরা প্রতিনিয়ত ভাল কিছু করার চেষ্টা করছি। আমাদের কাজ উন্নত করতে আপনারা মেরিনারদের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা/ উপদেশ পেলে সরকারী সকল আইন কানুন মেনে সবশক্তি দিয়ে আরও ভাল কিছু করতে পারবো। এ ছাড়া এই করোনা মহামারীর সময়ে, যদি শিপিং অফিসে কারো কোন ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় এবং তিনি যদি আমার সাথে যোগাযোগ করেন, তাহলে সরকারী বিধিবিধানের আওতায় তার সকল ধরনের সহযোগীতা করার চেষ্টা করব। তবে অনুরোধ হচ্ছে, না জানিয়ে দুর দুরান্ত থেকে কেউ যেন শিপিং অফিসে না আসে।”
তিনি উক্ত বক্তব্যে আরো জানান, “আমরা সীফ্যায়ারারদের সকল ধরনের সিডিসি ইস্যুর আবেদন অনলাইনে গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করব। এই প্রক্রিয়া চালু হলে একজন সীফ্যায়ারার ঘরে বসেই সিডিসির জন্য আবেদন করতে পারবেন। সঠিক আবেদন সম্পন্ন হলে সিডিসি ইস্যুর আগে শিপিং অফিসে সীফ্যয়ারারকে আসতে হবেনা।”
লাইট হাউজ নিউজ ক্লাবকে দেয়া বক্তব্যে, ক্যাপ্টেন হাছান মাহমুদ বলেন, সরকারি শিপিং অফিস ডিজিটালাইজেশনের ফলে শিপিং অফিসের কাজকর্ম এখন অনেক প্রাণবন্ত‌ এবং যেকোন সমস্যা খুব অল্প সময়ে সমাধান করে আসা যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন হাসান মাহমুদ বলেন- পূর্বের দিনগুলোতে শিপিং অফিসে কোনো কাজই একদিনে শেষ করা যেত না, কিন্তু এখন কোন কাজই দুই থেকে আড়াই ঘন্টার বেশি লাগেনা।
তিনি বলেন সরকারের এই উন্নয়নের ধারা যাতে অব্যাহত থাকে তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে, মেরিটাইম জাতি এগিয়ে যাবে, আরো অনেক দূরে।
মূলত বাংলাদেশী সীফ্যারারদের জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী সেবা প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি সমুদ্র পরিবহন (শিপিং) অফিস নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশা করি তাদের এই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সেক্টরে বাংলাদেশী সীফ্যারারদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখবে।