সব দোষ নাবিকের, জাহাজ মালিকরা শুধু মুনাফা নিবে।

প্রকাশিত: ১২:০৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক: নৌপথে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হলেও এর দায় নিতে রাজি নন লঞ্চ, অয়েল ট্যাংকার ও কার্গো মালিকরা। তা চাপাতে চান নৌযানে থাকা নাবিক ও শ্রমিকদের ওপর। চলন্ত অবস্থায় মালিকরা জাহাজে থাকেন না- এ যুক্তি দেখিয়ে দুর্ঘটনার দায় থেকে মালিকদের নাম বাদ দেয়ার পৃথক প্রস্তাব দিয়েছে নৌযান মালিকদের পাঁচটি সংগঠন।
শুধু তা-ই নয়, নৌ-দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিতে মালিক পক্ষের প্রতিনিধি রাখার বিধান যুক্তেরও প্রস্তাব করেছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল আইনের খসড়ার ওপর মতামত দিতে গিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন অধিদফতরে এসব প্রস্তাব দেয় সংগঠনগুলো। এতে দুর্ঘটনা ও আইন লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারা থেকে ‘মালিক’ শব্দ বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। দায় নিয়ে মতভেদ থাকলেও সাজা কমানোর প্রশ্নে একট্টা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। সব সংগঠনই সে প্রস্তাব করেছে। কোনো ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে শুধু অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করেছে। এছাড়া নৌ খাতে মালিক সংগঠনগুলোর কর্তৃত্ব বাড়াতে বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে নৌযান মালিকের সদস্যপদ নেয়ার বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন। এসব মতামত বিবেচনায় নিয়ে কয়েকটি ধারায় সাজা কমানোর কথা চিন্তাও করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন অধিদফতর।

নৌ-দুর্ঘটনা সংক্রান্ত অপরাধের দায় থেকে মালিকদের বাদ দেয়ার প্রস্তাবের যৌক্তিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার (যাপ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সুন্দরবন লঞ্চের মালিক সাইদুর রহমান বলেন, এটাই যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, মালিক হিসেবে আমি মিটিং করছি, আর চালক স্টিয়ারিংয়ে না থেকে অন্য কাউকে দিয়ে পরিচালনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটল। এর দায় কি আমি নেব? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বাস দুর্ঘটনায় চালক আসামি হয়, আর লঞ্চ দুর্ঘটনায় মালিককে আসামি করা হয় কেন?

শুধু চালক নন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি থাকলে তাদেরও এ আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কেএম জামাল রোমেল। তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা জাহাজে সনদধারী একাধিক চালক নিয়োগ দেই। তারা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপরিবহন অধিদফতরের নির্দেশনা অনুসরণ করে জাহাজ পরিচালনা করার কথা। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো যদি সঠিক নির্দেশনা না দেয় এবং সেই কারণে দুর্ঘটনা হলে সংশ্লিষ্টদেরও আসামি করতে হবে। এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী কোনো দুর্ঘটনা হলে প্রাথমিকভাবে মালিক ও চালক আসামি হবেন। এরপর তদন্তে প্রমাণিত হবে কার দায় ছিল। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কোনো জাহাজে যোগ্য নাবিক না রাখার কারণে দুর্ঘটনা হলে এর দায় মালিক কি এড়াতে পারেন। জাহাজ নির্মাণে ত্রুটি ও পরিচালনায় পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট না রাখা, ওভারলোডিংসহ অন্যান্য অপরাধের দায় কি মালিক এড়াতে পারেন। অথচ বেশি যাত্রী বা মাল বহনের সুবিধা মালিক ভোগ করেন, চালক নন।

নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন বলেন, মালিকরা সাজা বিধান থেকে নিজেদের বাদ দেয়ার দাবি করতে পারেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী দুর্ঘটনায় মালিকেরও দায় রয়েছে। মহাপরিচালক পদে সম্প্রতি যোগ দেয়ায় আমি খসড়া আইনটি পড়তে পারিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিধানের বাইরে সুযোগ নেই।

অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করতে কয়েক বছর ধরে কাজ করছে নৌপরিবহন অধিদফতর। খসড়া করা হলেও মালিক ও শ্রমিকদের চাপের মুখে চূড়ান্তকরণ বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি খসড়া আইনের ওপর বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের মতামত নেয়া হয়েছে। এতে সরকারি সংস্থার মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি এবং মালিক ও শ্রমিকদের ৯টি সংগঠন মতামত দিয়েছে।

এতে দেখা যায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থা (যাপ) খসড়া আইনের ৮৭(২) ধারা থেকে মালিকের নাম ও দণ্ড বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছে। এছাড়া অর্থদণ্ড দুই লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণের কথা বলেছে। একই প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ অয়েল ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও লঞ্চ মালিক সমিতি। খসড়া আইনের এ ধারায় নৌযানের ত্রুটি বা মালিক-চালকের অদক্ষতা ও অসতর্কতার কারণে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলে মালিক, চালকসহ দায়ীদের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ ওভারলোডিং। খসড়া আইনের ৯৮ ধারায় নির্ধারিত সংখ্যার বেশি যাত্রী বা মাল বহনের সময় মালিক বা তার প্রতিনিধি বা মাস্টার যিনি উপস্থিত থাকবেন তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। এ অপরাধে অতিরিক্ত প্রত্যেক যাত্রীর জন্য অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ধারা থেকেও মালিকদের নাম বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছে যাপ, কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, অয়েল ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও লঞ্চ মালিক সমিতি। খসড়া আইনের ৭৩(ক), ৭৫, ৮২ ও ১১০ ধারার সাজা থেকে মালিকদের নাম বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছে বেশির ভাগ মালিকদের সংগঠন। ৭৩(ক) ধারায় নৌযান নির্মাণে ত্রুটি, ৭৫ ধারায় জরিপ সনদ জাহাজে ঝুলিয়ে না রাখা, ৮২ ধারায় ফিটনেস ও নিবন্ধন ছাড়া নৌযান পরিচালনা করা এবং ১১০ ধারায় পণ্য পরিবহনে ব্যক্তিবিশেষে বৈষম্য করার অপরাধে সাজার বিধান রয়েছে।

সাজা কমাতে একট্টা : মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খসড়া আইনে কিছু অপরাধে ফৌজদারি আদালতে বিচারের বিধানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। তারা বলেছেন, এতে একই অপরাধের জন্য একাধিক মামলা হবে, যা সংবিধানের ৩৫(২) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। প্রস্তাবিত আইনের ৫৫(২) ধারায় আদালতের বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এতে মালিক বা চালকের গাফিলতি বা অদক্ষতার কারণে দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি বা অঙ্গহানি ঘটলে দায়ী প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এই উপধারার বিরোধিতা করেছে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। একইভাবে আরও কয়েক ধরনের অপরাধে সাজা কমানোর প্রস্তাব করেছে সংগঠনগুলো। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌযানের জন্য ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির বিধানও বাতিলের দাবি জানিয়েছেন মালিকরা।