হালদা নদীর অব্যবস্থাপনায় নষ্ট হচ্ছে হোয়াইট গোল্ড খ্যাত নয় প্রকারের চিংড়ি রেনু

প্রকাশিত: ৬:২৭ অপরাহ্ণ, মে ২৮, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক- প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননে দেশের একমাত্র নদী চট্টগ্রামের হালদা। হালদায় কার্প বা রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে এবার সর্বোচ্চ সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। কার্পজাতীয় মাছের ডিম আহরণ করতে গিয়ে ‘হোয়াইট গোল্ড’ খ্যাত চিংড়ি মাছের পোনা ধ্বংস হয় অবহেলায়। হালদা নিয়ে গবেষক, গবেষণা, গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ কোনো কিছুরই কমতি নেই। আছে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার পাওয়ার সুযোগও। কিন্তু মৎস্য রপ্তানির সর্বোচ্চ খাত চিংড়ির পোনা সংরক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ।

চলতি মৌসুমে ডিম সংগ্রহের পর দুটি হ্যাচারিতে নিয়োজিত স্থানীয় পোনা উৎপাদনকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেলো ভয়াবহ তথ্য। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, ডিম সংগ্রহের মূল সময়টাতে ডিমের সাথে চিংড়ি পোনা থাকে ১০ থেকে ২০ ভাগ। আর যখন ডিম কম ছাড়ে, তখন কার্পজাতীয় ডিমের সমপরিমাণ চিংড়ি পোনা তাদের জালে উঠে আসে।
রাউজানের ওসমান আলী ছোটকাল থেকেই হালদায় ডিম আহরণ আর মাছ শিকার করেই জীবন কাটানোদের একজন। তিনি বলেন, ‘বাগদা, গলদাসহ কয়েক রকম চিংড়ি পোনা আমাদের জালে আসে। ডিম হ্যাচারিতে নেওয়ার পর ওগুলোর তেমন যত্ন নেওয়া হয় না। আবার কেউ কেউ পুকুরে নিয়ে জাল পরিষ্কার করে। এতে তাদের জালে আসা চিংড়ির পোনা পুকুরে বেড়ে ওঠে। ওরা লাভবান হয়।’

হালদা নদীর অব্যবস্থাপনায় হুমকির মুখে হোয়াইট খ্যাত চিংড়ি
বংশ পরম্পরায় হালদায় ডিম আহরণকারী হাটহাজারীর সমীর বড়ুয়া  লাইটহাউস প্রতিনিধিকে জানান, এ বছর তার পুকুরে মাছ চুরি করতে এসে বিষ প্রয়োগ করে সব মাছ মেরে ফেলেছে চোরের দল। পুকুরের চিংড়ি পোনা ছাড়ার আগে তিনি প্রায় ৮০ হাজার টাকার চিংড়ি পোনা বিক্রি করেছেন। বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা মাছের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ লাখ টাকার বেশি বলেও জানান পঞ্চাশোর্ধ সমীর।


হালদা গবেষক ও প্রবীণ অধ্যাপক ড. আলী আজাদীর গবেষণায় ওঠে আসে হালদায় ৯৩ প্রজাতির মাছ ও ক্রাস্টাশিয়ান্স রয়েছে। এর মধ্যেই চিংড়িই শুধু ৯ প্রজাতির। যার মধ্যে বাগদা ও গলদা অন্যতম। তিনি বলেন, ‘ডিম আহরণের সময় চিংড়িসহ অন্য পোনা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য জেলেদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কার্পজাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহের পাশাপাশি যদি চিংড়ি পোনা সংরক্ষণ করা যায় তবে দেশে চিংড়ি চাষের চিত্রও বদলে যাবে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে আরো বেশি পরিমাণ চিংড়ি রপ্তানি করা যাবে।’

হালদার আরেক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘চিংড়ি পোনা নষ্টের বিষয়টি এতদিন আমাদের নজরে আসেনি। আমরাও কার্পজাতীয় মাছের ডিম নিয়ে ব্যস্তছিলাম। চিংড়ির দিকে ঠিক সেভাবে গুরুত্ব দিতে পারিনি। চট্টগ্রাম প্রতিদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে এনেছে। সংগৃহীত ডিম হ্যাচারিতে ছেড়ে দিয়ে জাল যদি নদীতে ধুয়ে নেওয়া হয়, তবে নদীর চিংড়ি নদীতেই বেড়ে উঠবে। আমরা আগামী মৌসুমে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নেবো।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫০৯ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। চিংড়ি রপ্তানি ক্ষেত্রে ইউরোপ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাপানেও চিংড়ি রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৬১ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি রপ্তানি করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ ১৭৭ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি।

এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা বাড়ছে। ২০১৪ সালে ৪৩ লাখ মেট্রিক টন চিংড়ির চাহিদা ছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চিংড়ির চাহিদা বেড়ে হয়েছে ৪৮ লাখ মেট্রিক টন।

রপ্তানি ছাড়াও দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কৃষির অন্যান্য উপ খাত যেমন শস্য, প্রাণিসম্পদ ও বনের তুলনায় অনেক বেশি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিধানেও মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রায় ৬০ ভাগ প্রাণিজ আমিষের জোগান দেয় মাছ। যার বিশাল একটা অংশের যোগান দেয় চিংড়ি।