সমুদ্র, জাহাজ এবং বরফ – স্মৃতিতে টাইটানিক

প্রকাশিত: ৪:৩৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২

যখন এই লেখাটা লিখছি তখন আমার জাহাজের অবস্থান কানাডার নিউ ফাউনল্যান্ড থেকে ২৫০ মাইলের মত দক্ষিণে, টাইটানিক স্মৃতিস্থভের শহর হ্যালিফ্যাক্স এবং নোভা স্কটিয়া থেকে ২০০ মাইলের মত পূর্বে, যেখানে উত্তর মেরুর হিম শীতল বরফ গলা জলের স্রোত ল্যাব্রাডর সমুদ্র হয়ে উত্তর আটলান্টিকে মিশছে, বাতাসের তাপমাত্রা মাঝেমাঝে –১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে যেখানে সমুদ্র খুব উত্তাল, কোথাও কোথাও সাদা বরফে আবৃত।

নোভা-স্কটিয়ার-উপকূল-উত্তর-আটলান্টিক

নোভা-স্কটিয়ার-উপকূল-উত্তর-আটলান্টিক

সমুদ্র,জাহাজ এবং বরফের কথা বলতেই আমাদের সবার মাথায় চলে আসে টাইটানিক বিপর্জয়ের কাহিনী। গল্প শুনে হোক অথবা সিনেমা দেখে হোক টাইটানিক জাহাজের কথা আমাদের সবার কম বেশি জানা। আরএমএস টাইটানিক, ব্রিটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ, যেটি ১৫ই এপ্রিল ১৯১২ সালে সাউদাম্পটন, যুক্তরাজ্য থেকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে তার প্রথম সমুদ্রযাত্রার সময় একটি আইসবার্গে আঘাত করার পরে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়। সামুদ্রিক নিরাপত্তার পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, ১৫০০ জনের বেশী প্রাণহানি সারাবিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো।১১০ বছর পরে এসেও আজও  টাইটানিক বিপর্যয় সামুদ্রিক নিরাপত্তার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। হয়েছে অনেক অনুসন্ধান, এসেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। অনুসন্ধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলির মধ্যে একটি ছিল ১৯১৪ সালে আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য সেফটি অফ লাইফ অ্যাট সি (SOLAS) এর প্রতিষ্ঠা, যা আজও সামুদ্রিক নিরাপত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।

বরফ-কেটে-চলা_সেন্ট-লরেন্স-উপসাগর

বরফ-কেটে-চলা_সেন্ট-লরেন্স-উপসাগর

ব্রিটিশ হোয়াইট স্টার লাইন শিপিং এর সবচেয়ে সিনিয়র ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথ, চিফ মেট হেনরি টিংগেল ওয়াইল্ড, ফার্স্ট অফিসার উইলিয়াম ম্যাকমাস্টার মারডক ও দ্বিতীয় অফিসার চার্লস লাইটোলার নিয়ে গঠিত একদল চৌকস নাবিকদের নেতৃত্বে টাইটানিক ১০ই এপ্রিল, ১৯১২ ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে রওনা হয়েছিল।

 

কুইন্সটাউন ছেড়ে যাওয়ার পর, টাইটানিক আইরিশ উপকূল ধরে  ফাস্টনেট রক পর্যন্ত প্রায় ৫৫  নটিক্যাল মাইল (৬৩ মাইল, ১০২ কিমি) যাত্রা করে । সেখান থেকে  ১,৬২০ নটিক্যাল মাইল (১,৮৬০ মাইল; ৩,০০০ কিমি) উত্তর আটলান্টিক জুড়ে একটি গ্রেট সার্কেল পথ ধরে নিউফাউন্ডল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে “কোণা” নামে পরিচিত সমুদ্রের একটি জায়গায় পৌঁছানোর জন্য রওনা হয়েছিল। যাত্রার শেষ ধাপটি ছিল ১৯৩ নটিক্যাল মাইল (২২২ মাইল; ৩৫৭ কিমি) অ্যামব্রোস লাইট এবং অবশেষে নিউ ইয়র্ক হারবার পর্যন্ত। ১৭ই এপ্রিল সকালে নিউ ইয়র্ক পৌঁছানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

 নিউফাউন্ডল্যান্ড-এবং-লাব্রাডর-এর-দক্ষিণ-উপকূল-থেকে-ধারন-করা


নিউফাউন্ডল্যান্ড-এবং-লাব্রাডর-এর-দক্ষিণ-উপকূল-থেকে-ধারন-করা

১৪ইএপ্রিল, ১৯১২ রাত ১১টা ৪০ মিনিট (জাহাজের সময়) একটি আইসবার্গের সাথে সংঘর্ষের পর ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট পরে ডুবে যায় টাইটানিক। সামদ্রিক দূর্ঘটনাগুলোর ভিতরে সর্বাধিক প্রানহানির সকল মাইলফলক ছাড়িয়ে, রচিত হয় এক মর্মান্তিক ইতিহাস।

এখন কথা হচ্ছে, কেনো এই স্মৃতিচারণ!

এই স্মৃতিচারণের একটাই কারন, নোভা স্কটিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অক্ষাংশে 41° 43′ 32″ উত্তর, দ্রাঘিমাংশে 49° 56′ 49″ পশ্চিম স্থানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২.৫ মাইল (৪ কিমি) গভীরে উত্তর আটলান্টিকের তলদেশে যে ইতিহাস শায়িত আছে, তার খুব নিকট দিয়ে পরিকল্পনা করেছি আমাদের বর্তমান সমুদ্রযাত্রাটি, গন্তব্য নিউ ইয়র্ক।

ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথের সময়ের ১১০ বছর পরে, একই সমুদ্রে একই গন্তব্যে জাহাজ চালাতে যেয়ে একরকম নস্টালজিয় অনুভব করছি। অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি কল্যাণে আবহাওয়া রিপোর্ট এবং বরফ সতর্কতা সহ নেভিগেশন বার্তাগুলি নিয়মিত হাতে আসছে। পর্যালোচনা করে পরিকল্পিত গতিপথ পুনঃনিরীক্ষণ করে এগিয়ে যাচ্ছি।

তবে ১৯১২ থেকে ২০২২, সময় বদলেছে একশো, নিয়ম বদলেছে হাজার, কিন্তু সমুদ্র বদলায়নি তার চিরচেনা রুপ।

 

তন্ময় রায়

মার্চেন্ট নেভি অফিসার

উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর  থেকে।